সারা দেশে মক ভোট আয়োজনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:১২ এএম

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিদ্যমান নীতিমালার নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ভোটগ্রহণ শেষ করা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাম্প্রতিক ‘মক ভোটিং’ বা পরীক্ষামূলক ভোটগ্রহণের তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। আমার দেশকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে সাংবিধানিক সংস্থাটির নির্ভরযোগ্য সূত্র।

মক ভোটিং নিয়ে কথা বলেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরাও। তারা বলেন, গণভোট সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞ। তাই বেশি বেশি প্রচার করা দরকার। এমনকি রাজধানীর বাইরে অনগ্রসর এলাকায় মক ভোটিং করা হলে সুফল পাবে ইসি।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, একজন ভোটারের ভোট দিতে যে সময় প্রয়োজন, তা বর্তমান নীতিমালায় বরাদ্দ করা সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে পুরুষ ভোটারদের ক্ষেত্রে এই সময়ের ব্যবধান প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমান ভোটগ্রহণ হয় সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত, মোট আট ঘণ্টার।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তসহ চারটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে আজ রোববার নির্বাচন ভবনে বসছে ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য দশম কমিশন সভাটি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।

ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, কমিশনের এ বৈঠকে মোট চারটি প্রধান বিষয় আলোচ্য সূচিতে স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এ সভার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে আসন্ন নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে।

অপর যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা কমিশন সভায় আলোচনা হবে, সেগুলো হলো- ভোটের সময় ও কক্ষ বাড়ানোর বিষয়ে পর্যালোচনা। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় থাকা নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। আর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে কমিশনের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে মতামত প্রদান।

পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন না বেসরকারি চাকরিজীবীরাপোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন না বেসরকারি চাকরিজীবীরা
ইসি সূত্রে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি ‘গণভোট’ একসঙ্গে আয়োজন করছে ইসি। এই প্রেক্ষাপটে গত ২৯ নভেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ইসির পক্ষ থেকে একটি মক ভোটিং হয়। সেখানে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে তৈরি করা একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি কমিশন পর্যায়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে ভোটগ্রহণের সময় ও কক্ষ বাড়ানোর বিষয়টি উঠে আসে। এর আলোকে ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখা একটি কার্যপত্র তৈরি করেছে, যা আজ কমিশন সভায় উত্থাপন করার কথা আছে।

মক ভোটিংয়ের ফলাফলে দেখা গেছে, একজন পুরুষ ভোটারের ভোট দিতে গড়ে সময় লাগছে এক মিনিট ২২ সেকেন্ড। ১০ শতাংশ বাফার টাইম (বাড়তি সময়) ধরলে তা দাঁড়ায় এক মিনিট ২৮ সেকেন্ড।

অথচ নতুন নীতিমালা অনুযায়ী একটি ভোটকক্ষে ৬০০ পুরুষ ভোটার থাকলে আট ঘণ্টার ভোটিং সময়ে একজন ভোটার সময় পাবেন ৪৮ সেকেন্ড। অর্থাৎ, একজন পুরুষ ভোটারের ভোট দিতে প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক সময় বরাদ্দ আছে।

অন্যদিকে, নারী ভোটারদের ক্ষেত্রেও চিত্রটি প্রায় একই। মক ভোটিংয়ে দেখা যায়, একজন নারী ভোটারের ভোট দিতে গড়ে এক মিনিট ৩০ সেকেন্ড সময় লাগছে, যা বাফারসহ এক মিনিট ৩৯ সেকেন্ডে দাঁড়ায়। কিন্তু বর্তমান নীতিমালায় প্রতি ৫০০ নারী ভোটারের জন্য একটি কক্ষ বরাদ্দ থাকায় তারা সময় পাবেন এক মিনিট ৩৬ সেকেন্ড। অর্থাৎ, এখানেও বরাদ্দ করা সময় প্রয়োজনের তুলনায় কম।

ইসি সচিবালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মাঠ পর্যায় থেকে সারা দেশে মোট ৪২ হাজার ৭৬৬টি ভোটকেন্দ্র ও দুই লাখ ৪৫ হাজার ১৯৫টি ভোটকক্ষ চূড়ান্ত করা হয়েছে। বর্তমানে প্রতি ভোটকক্ষে গড়ে ৫১৫ জন ভোটার আছেন। কিন্তু মক ভোটিংয়ের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, এই বিন্যাসে নির্ধারিত আট ঘণ্টার মধ্যে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।

বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করে ইসির এক কর্মকর্তা জানান, মক ভোটিংয়ের এই ফলাফলের পর কমিশনকে এখন বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সমাধানের পথ মূলত দুটি—হয় ভোটকক্ষের সংখ্যা বাড়িয়ে প্রতি কক্ষে ভোটারের সংখ্যা কমাতে হবে, নতুবা ভোটগ্রহণের সময়সীমা (বিকাল ৪টার পরিবর্তে) আরো বাড়াতে হবে। বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য আজ আলোচনা হওয়ার কথা আছে। এর আগে নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানিয়েছিলেন, কমিশন সভায় আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ভোটের সময় ও কক্ষ বাড়ানো হবে কি না।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) সভাপতি মুনিরা খান আমার দেশকে বলেন, গণভোটের বিষয়টি অধিকাংশ মানুষেরই অজানা। ভোটের দিন এই চার্টার পড়ে ভোট অনেকেই দিতে পারবেন না। কারণ, সবাই শিক্ষিত নন। আবার যারা শিক্ষিত, তাদেরও পড়ে ভোট দিতে গেলে সময় বেশি লাগবে। তিনি বলেন, ঢাকায় মক ভোটিং হয়েছে। এটা ঢাকার বাইরে বস্তি ও দুর্গম এলাকায় করলে ভালো হতো। নতুন এ বিষয়ে ব্যাপকভাবে প্রচার চালাতে হবে, যাতে মানুষ এ সম্পর্কে সচেতন হয়।

পোস্টাল ভোটের নিবন্ধনের সময় বাড়ল: প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটাররা আগামী ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পোস্টাল ভোট বিডি অ্যাপে নিবন্ধন করতে পারবেন। গতকাল শনিবার সময় বাড়িয়ে নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই অ্যাপে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশাপাশি দেশের তিন শ্রেণির মানুষ নিবন্ধন করতে পারবেন। তারা হলেন- সরকারি কর্মকর্তা, নির্বাচনি কর্মকর্তা ও কারাবন্দিরা। তবে তফসিলের পর দেশের ওই তিন শ্রেণির মানুষ নিবন্ধিত হবেন। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন এক লাখ ৯৮ হাজার ৪৫৭ জন।

অধিকাংশ নতুন দল নিবন্ধনে অযোগ্য: সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনে কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত দুটি দলকে নিবন্ধন দিয়েছে ইসি। মোট ১৪৩টি আবেদন পাওয়ার পর নথি যাচাই, মাঠ পর্যায়ের তদন্ত ও আপিল প্রক্রিয়া শেষে অধিকাংশ দলই শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ইসি জানায়, শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় মোট ১২১ দলকে নিবন্ধনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

ইসির নিবন্ধন শাখার তথ্যমতে, কঠোর যাচাইয়ের পর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) (প্রতীক শাপলা কলি) এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) (প্রতীক কাঁচি) নিবন্ধিত হয়েছে। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে সঠিকতা পাওয়ায় বাংলাদেশ আমজনগণ পার্টিকে নিবন্ধনের বিষয়ে আপত্তি আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে ১৩টি আপত্তি জমা পড়ে। এসব আপত্তির শুনানির প্রক্রিয়া এখনো চলমান।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির করা রিটের রায় কমিশনে আজ উপস্থাপন করা হচ্ছে। অপরদিকে আপিলের পর ‘আমজনতার দল’ ও ‘জনতার দল’-এর বিষয়ে পুনঃতদন্তে সঠিকতা পাওয়ায় তাদের নিবন্ধনে আপত্তির আহ্বান জানিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এগুলোর বাইরে আজ নিবন্ধন-সংক্রান্ত আরো কয়েকটি দলের বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য কমিশন সভায় কার্যপত্র উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে ফরওয়ার্ড পার্টি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি, বাংলাদেশ বেকার সমাজ, সলুশন পার্টি, নতুন বাংলাদেশ পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ আরো বেশ কয়েকটি দল।

এনআইডি সংশোধনে ফি বাড়ানোর প্রস্তাব: এনআইডির তথ্য সংশোধনের জন্য আবেদন ফি সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ। বর্তমানে যে আবেদন করতে ফি দিতে হয় ৪০০ টাকা। আপিল বা রিভিশন আবেদনের জন্যও নাগরিকদের গুনতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট। একজন নাগরিক তার এনআইডির তথ্য সংশোধনে যতবার আবেদন করবেন, ততবারই গুণিতক হারে বাড়তি ফি জমা দিতে হবে। বাড়তি এসব ফি অন্তর্ভুক্ত করে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র ও সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত (সংশোধন, যাচাই এবং সরবরাহ) প্রবিধানমালা’ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে জন্মতারিখে সংশোধন কার্যক্রম মাঠ পর্যায় থেকে বাদ দিয়ে ঢাকায় আনা হচ্ছে। আজ অনুষ্ঠেয় নির্বাচন কমিশনের সভায় এ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য এজেন্ডায় রাখা হয়েছে। ওই প্রস্তাব অনুমোদন হলে এনআইডির তথ্য সংশোধনে বাড়তি ফি জনগণের মাথায় চাপবে।

সংসদের ব্যালটে থাকছে না চারটি প্রতীক: ব্যালটে থাকছে না কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক এবং নিবন্ধন বাতিল থাকায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন (চাবি), ফ্রিডম পার্টি (কুড়াল) ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি-পিডিপি (বাঘ)। সাধারণ ভোটে অংশগ্রহণকারী দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতীক থাকবে।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর